দ্বন্দ্ব নয়, দেশের স্বার্থ সবার আগে
শরিফুল হাসান
বিশ্বে প্রবাসী আয়ের শীর্ষস্থানীয় দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১২, এই ৩৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮৩ লাখ লোকের। আর এই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৬৮ লাখ কোটি টাকা। জনশক্তি রপ্তানি খাতের সংকট নিয়ে কথা বলতে গেলেই আসবে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য আর প্রতারণায় সর্বস্বান্ত মানুষের করুণ কাহিনি। এসব বন্ধ করতেই সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আর সেটি নিয়েই এখন বায়রা আর মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। এক পক্ষ এখন ধর্মঘট করেছে, আরেক পক্ষ আলোচনার বদলে বায়রার নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত্র মালয়েশিয়ায় সরকারি উদ্যোগে লোক পাঠানো নিয়ে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া নিয়মিত কর্মী নেওয়া শুরু করে। ১৯৯৬ পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু তত দিনে সারা দেশ ছেয়ে গেছে দালাল চক্র। এসব অপতৎপরতার কারণে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ রাখে মালয়েশিয়া। দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ২০০০ সালে এসে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মালয়েশিয়া। অনিয়মের কারণে ২০০১ সালে আবার জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। এরপর ২০০৭ ও ২০০৮ সালে চার লাখ কর্মী যান দেশটিতে। ২০০৯ সালে লোক নেওয়া বন্ধের পর প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীসহ সবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় প্রায় চার বছর পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া। এবার প্রতারণা বন্ধে দুটি দেশই সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয় সরকারি নিবন্ধন-প্রক্রিয়া। ১৩ থেকে ২১ জানুয়ারি সারা দেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় নিবন্ধন চলে। ভোট দেওয়ার মতোই আনন্দ নিয়ে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছেন। নয় দিনে সারা দেশে সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন শেষে প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ইউনিয়ন কোটায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে লটারি করে প্রথম দফায় যাওয়ার জন্য সাড়ে ১০ হাজার প্রার্থীকে চূড়ান্ত করা হয়, যেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি কেউই। মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২৭ মার্চ থেকেই কর্মী যাওয়া শুরু করবেন। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ৭ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে বায়রা এই প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে তারা কর্মবিরতি শুরু করে। কর্মবিরতির দুই দিন পর বুধবার বায়রার সভাপতি, মহাসচিবসহ অজ্ঞাতনামা ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএমইটি। একের পর এক শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কারণেই বায়রা এতটা মরিয়া। ২০০৮ সালে কুয়েতের এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা। এরই মধ্যে সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য সমঝোতা ও নিবন্ধন-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়। তাই শেষ অস্ত্র হিসেবে শুরু করা হয় ধর্মঘট। অন্যদিকে সরকার কঠোর অবস্থানে। মন্ত্রী বলেছেন, বায়রা এ মন্ত্রণালয়ের কেউ নয়। আর এ পর্যন্ত যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁদের শতকরা ৯০ ভাগই ব্যক্তিগত চেষ্টায় ভিসা এনেছেন। বায়রার সদস্যরা বলছেন, ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ এবং সরকারি সব ধারা অনুযায়ী, বিদেশে কর্মী নিয়োগের চাহিদা সংগ্রহ থেকে শুরু করে লোক পাঠানো পর্যন্ত পুরো কাজে মূল ভূমিকা পালন করেন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা। এ ছাড়া টাস্কফোর্স, কল্যাণ তহবিলসহ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি রপ্তানি-সংক্রান্ত সব কমিটিতেই সরকারের সঙ্গে বায়রা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, বায়রাকে বাদ দিয়েই জনশক্তি রপ্তানি খাত এগিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মঘট বন্ধের পর বিদেশে কর্মী যাওয়া অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার কর্মী বিদেশে যেতেন, এখন প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ কর্মী যাচ্ছেন।আমরা মনে করি, বায়রাতেও যে ভালো সদস্য আছেন, তাঁরাও যে সৎভাবে ব্যবসা করতে চান, সেটি প্রমাণ করতে হলে তাঁদের সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। আর মন্ত্রীরও উচিত, বায়রার সদস্যদের দূরে সরিয়ে না রেখে তাঁদের নিয়মের মধ্যে আনা। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছে বায়রার হাত ধরেই এই খাত এত দূর এসেছে। কাজেই তাঁদের অবদান উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং বায়রার এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত। আর মন্ত্রণালয়ের উচিত মালয়েশিয়া বাদে অন্য যে বাজারগুলোতে এখনই সরকারিভাবে লোক পাঠানো সম্ভব নয়, সেখানে বায়রার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। সরকার মালয়েশিয়ায় যেভাবে নিবন্ধন করেছে, একইভাবে সারা দেশ থেকে বিদেশগামীদের নিয়ে তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে পারে। এরপর সেখান থেকে লটারি করে প্রার্থী বাছাই করলে দালালপ্রথা এমনিতেই ভেঙে যাবে। সরকারিভাবে নিবন্ধনের পর কোন দেশে যেতে কত খরচ হবে, সেটিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে ঠিক করুক সরকার। এরপর প্রতিটি রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সির জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে একটি করে হিসাব নম্বর ঠিক করা হোক। সেই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিক বিদেশগামী কর্মীরা। তাহলে কে কত খরচে যাচ্ছে, খুব সহজেই সেটি দেখতে পারবে সরকার। প্রতারণার সুযোগ থাকবে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, নিজের টাকা খরচ করে কর্মীরা যাচ্ছেন, কল্যাণ তহবিলে তাঁদের দেওয়া টাকা থেকেই চলছে মন্ত্রণালয়, দূতাবাসের কাজকর্ম। আর প্রবাসীদের পাঠানো টাকায়ই স্ফীত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। কাজেই প্রবাসীরা যেন নিরাপদে বিদেশে যেতে পারেন, তাঁরা যেন প্রতারিত না হন, সে জন্য সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে একটি প্রক্রিয়া বের করতে হবে। এখন কাউকে বাদ দিয়ে কেউ স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেলেই সংকট বাড়বে। সরকারের এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা উচিত, যাতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, ব্যবসায়ীরা যত প্রভাবশালীই হোক, সাধারণ নাগরিকেরা যেন প্রতারিত না হয়ে কম খরচে বিদেশে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অযথা যুদ্ধাবস্থা তৈরি না করে ব্যবসায়ী-সরকার সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এই খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে, আর এর সুযোগ নেবে অন্য কোনো দেশ। তাই অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব নয়, দেশের স্বার্থ ভাবতে হবে সবার আগে।



