চকলেট চাই না, মা, তুমি ফিরে আসো

Spread the love

শরিফুল হাসান

লিবিয়ায় এখন চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। গাদ্দাফির সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে প্রতিদিন অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। লিবিয়ার বিভিন্ন শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসছেন আহত লোকজন। ফলে চিকিৎসক ও সেবিকাদের এখন দম ফেলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ৭০০ চিকিৎসক ও সেবিকা আছেন লিবিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে। এঁদের বেশির ভাগই আবার নারী। সরকারিভাবে তাঁরা সেখানে গেছেন। কিন্তু লিবিয়ার বর্তমান সহিংস পরিস্থিতিতে কেমন আছেন তাঁরা?লিবিয়া প্রবাসী নারী চিকিৎসক ও সেবিকাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। কিন্তু দেশে ফেরার পথ নেই। কারণ, তাঁদের পক্ষে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিসর কিংবা তিউনিসিয়া সীমান্তে যাওয়া সম্ভব নয়। এই নারীরা জানান, দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন তাঁরা। কারণ, দেশে স্বজনেরা প্রতি মুহূর্তে তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা করছে। কিন্তু তাঁদের উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকার এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রতিটি দিনই তাঁরা দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন। লিবিয়া থেকে সাতজন প্রবাসী নারী কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। জানিয়েছেন তাঁদের অনুভূতি ও আতঙ্কের কথা। সরকারকে তাঁরা অনুরোধ করেছেন, দ্রুত যেন তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইশরাত জাহানের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। লিবিয়ার ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারে (টিএমসি) সেবিকা হিসেবে আছেন। ওই হাসপাতালে আরও ১১ জন বাংলাদেশি চিকিৎসক ও সেবিকা আছেন। বাংলাদেশি ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক আছেন এই হাসপাতালে। ইশরাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের ভেতরে কোয়ার্টারে থাকি। হাসপাতালের পরিচালক কয়েক দিন আগে সব বিদেশিকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি বলেছেন, আপনারা কাজ চালিয়ে যান। আপনাদের কোনো বিপদ হবে না। কিন্তু এর পরও ফিলিপাইনের লোকজন চলে গেছে। ভারতীয়রা কিছু গেছে, এখনো কিছু আছে।’ইশরাত বলেন, ‘আমরা যাঁরা হাসপাতালের ভেতর থাকি, তাঁদের সমস্যা কম। কিন্তু যাঁরা বাইরের কোয়ার্টারে থাকেন, তাঁরা অনেক সমস্যায় আছেন। সব সময় তাঁরা আতঙ্কে আছেন। তাঁরা চাইছেন দেশে ফিরতে। দূতাবাসের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, ত্রিপোলিতে কোনো প্লেন নামছে না। কাজেই আমাদের নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ত্রিপোলি থেকেই ভারতীয়রা প্লেনে গেছে।’ ইশরাত আরও বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমরা দূতাবাসে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, অসংখ্য বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছে। আমরা আমাদের নাম-পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে এসেছি। আসলে এই পরিবেশে থাকা যায় না। সব সময় আতঙ্ক কাজ করে। আমাদের পক্ষে তো তিউনিসিয়া বা মিসরে যাওয়া সম্ভব নয়। বাইরে অনেক স্থানে ছিনতাই ও লুটপাট হচ্ছে। সবাই বলছে, ত্রিপোলিতে সামনে বড় ধরনের যুদ্ধ হবে। সেটি হলে আমাদের কে রক্ষা করবে? আমাদের পক্ষে তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তে যাওয়া সম্ভব নয়। আর যদি লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়, তাহলে আমরা কীভাবে দেশে ফিরব? আমরা রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নো ফ্লাই জোন করলে আমাদের কীভাবে উদ্ধার করবেন? তিনি বলেছেন, নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হলেও বেশি দিন থাকবে না। আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। খালেদা বেগম: সেবিকাএই হাসপাতালের আরেক সেবিকা খালেদা বেগম। বাড়ি সিলেটে। তিনি বলেন, ‘দেশে থাকা পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু নেটওয়ার্কে সমস্যা। সব সময় ভয়ে থাকি। যখন মারামারি হয়, তখন হাসপাতালে অনেক লাশ আসে। বুঝতে পারছি না কী করব। পরিস্থিতি ভালো হলে আমরা থাকতে চাই। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে আমরা দেশে ফিরতে চাই।’ বেনগাজি শহরের কেন্দ্রেই পরিবার নিয়ে থাকেন শারমিন নাহার ও তাঁর পরিবার। হাসপাতাল থেকে একটু দূরে ক্যাম্প করে থাকেন ২১ জন বাংলাদেশি। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বাইরে থাকি। যেতে-আসতে ভয় লাগে। বাসা থেকে গুলির শব্দ শুনি। বাচ্চা একজন। পরিবার নিয়ে আমরা যাঁরা আছি, তাঁরা আছি সবচেয়ে আতঙ্কে। কী করব বুঝতে পারছি না। আতঙ্কিত অবস্থায় অন্য দেশের লোকজন চলে গেছে। কিন্তু আমাদের নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এখনো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা দেশে ফিরতে চাই।’তাহমিনা জান্নাত লিবিয়ার মিসুরাতা শহরের সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক। দেশের বাড়ি খুলনায়। ওই হাসপাতালে মোট ৩০ জন বাংলাদেশি চিকিৎসক ও সেবিকা রয়েছেন। তাহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেতন-খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমরা আতঙ্কে থাকি সব সময়। শহরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষে প্রায়ই মারামারি হচ্ছে। আমরা আরবি ভাষা বুঝি না। তাই সবকিছু বুঝতে পারছি না। এখানকার পরিবেশ খুবই ভীতিকর-অস্বস্তিকর। হাসপাতালগুলোতে রোগী আসা বেড়েছে। তবে কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে না। চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’ তাহমিনা বলেন, ‘অনেক সুযোগ-সুবিধা দেখে এখানে এসেছিলাম। তখন তো আর জানতাম না লিবিয়ার পরিস্থিতি এমন হবে। এখন আমরা কী করব? আমাদের পক্ষে মিসর-তিউনিসিয়া সীমান্তে যাওয়া তো দূরের কথা, ত্রিপোলিতে যাওয়াও কঠিন। আমাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে নিতে সরকারের উচিত কোনো একটা ব্যবস্থা করা।’ অলকা পালের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। সেবিকার কাজ করছেন বেনগাজির আল বাইদা হাসপাতালে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইদা থেকেই লিবিয়ায় প্রথম সমস্যা শুরু হয়। পাঁচ-সাত দিন টানা দুই পক্ষে মারামারি চলে। স্থানীয় জনগণ আমাদের নানাভাবে ঝামেলা করছে। দেশে আমার স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে। এমন অনিশ্চয়তায় থাকতে চাই না আমরা। আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করুক সরকার।’ রীনা আসমার বাড়ি পিরোজপুরে। লিবিয়ার বেনগাজি শহরের শাহাদ উপশহরের শাহাচেস্ট হাসপাতালের সেবিকা তিনি। এই হাসপাতালে মোট তিনজন বাংলাদেশি আছেন। বেনগাজি থেকে এই এলাকার দূরত্ব ৬০০ কিলোমিটার।রীনা বলেন, ‘শাহাদ এলাকায় সব সময় গোলাগুলি হচ্ছে। অন্তত ৫০০ মানুষ মারা গেছে। অনেক রোগী আসছে। সারাক্ষণই হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। এই এলাকার পাশেই সুদান সীমান্ত। লিবিয়ানরা বলছে, পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কার্যত শহরে এখন কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভয়ে আমরা হাসপাতালের বাইরে যাই না। কয়েক দিন আগে কারা যেন এসে হাসপাতালের বিদ্যুৎ ও ডিশের লাইন কেটে দিয়ে গিয়েছিল। এখন পাহারা বসানো হয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে গেলে কী হবে জানি না। সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমাদের পাশেই সুদান সীমান্ত। ফলে এখানে সমস্যা আরও বাড়তে পারে।’ নাসরিন নাহারের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। তিনি সেবিকা হিসেবে কাজ করছেন ত্রিপোলির আবু সেলিম ট্রমা হসপিটালে (পঙ্গু হাসপাতাল)। স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি হাসপাতালের ভেতরে আবাসিক বাসায় থাকেন। এক মেয়ের বয়স ছয়, অন্যজনের তিন। নাসরিন বলেন, ‘পঙ্গু হাসপাতাল হওয়ায় সবচেয়ে বেশি রোগী এখানে আসে। গুলি খেয়ে প্রতিদিন শত শত রোগী আসে। সারাক্ষণ আমাকে আইসিইউতে কাজ করতে হয়। এমনও দিন যাচ্ছে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতে হচ্ছে। অনেকেই চোখের সামনে মারা যাচ্ছে। হাসপাতালের ফিলিপাইন ও ইউক্রেনের বিদেশি সব চিকিৎসক ও সেবিকা চলে গেছেন।’ নাসরিন আরও বলেন, ‘আমরা সব মিলিয়ে সাতজন বাংলাদেশি আছি। সব সময় আতঙ্ক নিয়ে থাকি। আমরা দূতাবাসে যোগাযোগ করেছি। দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, নিজ উদ্যোগে ত্রিপোলি থেকে আফ্রিকান এয়ারলাইনসে দুবাই, এরপর দুবাই হয়ে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। কিন্তু তিন মাসের বাচ্চাকে নিয়ে আমি কীভাবে বাসা থেকে বের হব? বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। মারামারি তো আছেই। আমরা বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চাই। এখানকার লিবিয়ানরা বলছে, গাদ্দাফি ক্ষমতা ছাড়বেন না। সামনে আরও বড় সংঘর্ষ হবে। তাঁরা দেশে ফেরার পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যান।’ বেনগাজির বাইদা এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন জান্নাতুল ফেরদৌস। বাড়ি সাভারে। পাঁচ বছরের মেয়ে নেহাকে দেশে বাবা-মায়ের কাছে রেখে তিনি ওখানে গেছেন। কাজ করছেন আল বাইদা হাসপাতালে। বেনগাজি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের এই এলাকায় আরও ২৩ জন বাংলাদেশি সেবিকা আছেন। জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী যে আতঙ্কে আছি, সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। আমরা হাসপাতালের বাইরে থাকি। হাসপাতাল থেকে কল এলেই যেতে হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা করছে স্থানীয় লিবিয়ানরা। রাস্তায় কোনো নিরাপত্তা নেই। হাসপাতালে সব সময় সশস্ত্র পাহারা থাকে। কয়েক দিন আগে কারা যেন হাসপাতালেও হামলা চালাতে এসেছিল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে থাকে। খাবার কিনতেও কষ্ট। আমাদের দ্রুত দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। বাইদা এলাকায় সারাক্ষণই গোলাগুলি চলছে। আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলির শব্দ শুনে মনে হয়, এখনই বোধহয় আমার সন্তান প্রসব হয়ে যাবে।’কান্নাজড়িত কণ্ঠে জান্নাতুল বলেন, ‘ভাই, আমরা খুব বিপদে আছি। আমাদের বেতন হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়ার চরম কষ্ট। আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না। সরকার আমাদের দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করুক। দেশে থাকা আমার পাঁচ বছরের মেয়ে নেহা সারাক্ষণই কাঁদছে। বলছে, “মা তুমি দেশে চলে আসো। আমার চকলেট লাগবে না। আমাদের কোনো টাকা লাগবে না। তবুও মা, তুমি দেশে চলে আসো। ‘আমি দেশে ফিরতে চাই।” কী বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাংলাদেশি যেসব চিকিৎসক ও সেবিকা আছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আজুরি বেঙ্গল লিমিটেডের মাধ্যমে সেখানে গেছেন। আজুরি বেঙ্গল লিমিটেডের ব্যবস্থাপক সামসুদ্দোহা তালুকদার প্রথম আলোকে জানান, লিবিয়ায় চিকিৎসক ও সেবিকা হিসেবে ৭০০ জনের মতো বাংলাদেশি গেছেন। এর মধ্যে ৪০০ জনই নারী। তিনি জানান, ‘আমরা নিয়মিত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে এসব মেয়ের পক্ষে সীমান্তে যাওয়া সম্ভব নয়। তাতে নানা ঝুঁকি আছে। আমরা তাই নিজ নিজ স্থানে সবাইকে নিরাপদে থাকতে বলেছি। সরকারের নির্দেশনার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।’লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বি এম নূরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই চিকিৎসক ও সেবিকাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তাঁরা মোটামুটি নিরাপদে আছেন। এখনই তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা করা যাবে না। আর নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হলে, পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.