বিএনপি হেরেছে দলীয় কোন্দলে
শরিফুল হাসান
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে বরাবরই সাংসদ নির্বাচিত হন কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সভাপতি হারুন-আল রশীদ। ১৯৭৩ সালের পর থেকে প্রতিবারই তিনি এখানে জিতেছেন। ২০০৮ সালে সারা দেশে আওয়ামী লীগের জোয়ারে তিনিও প্রথমবারের মতো হারেন। আর এবারের উপনির্বাচনে তিনি মনোনয়নই পাননি।এ অবস্থায় তিনি ও তাঁর সমর্থক, অনুসারী সবাই বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেনের বিপক্ষে কাজ করেছেন। মূলত দলীয় এই কোন্দলের কারণেই খালেদ হেরেছেন বলে জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা প্রথম আলোকে বলেছেন।বিএনপির এক নেতা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা বিএনপি ও ছাত্রদলের বেশির ভাগ নেতা এবং হারুন-আল রশীদের আত্মীয়স্বজন এবারের নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে কোনো কাজ করেননি। নির্বাচনের দিনও তাঁদের আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গেই দেখা গেছে। এ কারণে বিএনপি ও হারুন-আল রশীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত অনেক কেন্দ্রেও খালেদ হোসেন হেরেছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলের নেতারাই বলেছেন, এই আসনে বিএনপি হারার আরেকটি বড় কারণ আওয়ামী লীগের প্রার্থী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তিনি না হয়ে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো প্রার্থী হলে হয়তো হেরে যেতেন। কারণ মোকতাদির চৌধুরী গতবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব থাকার সময় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের কাজ করেছেন। যেসব এলাকায় ২০-৩০ বছরে রাস্তাঘাট হয়নি, সেসব এলাকায় তিনি পাকা রাস্তা করেছেন। তিনি নির্বাচিত হলে এলাকার অনেক বেশি উন্নয়ন হবে—স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে গ্রামের দিকের লোকজন মনে করেছেন। বিশেষ করে বিজয়নগর এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন করেছেন মোকতাদির চৌধুরী। এরই ধারাবাহিকতায় এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিজয়নগরকে আলাদা উপজেলা করা হয়। উপনির্বাচনে ওই উপজেলার সাতটি ইউনিয়নেই একচেটিয়া ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ।জেলা বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির এই আসনে হারার আরেকটি বড় কারণ সংসদ বর্জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবার তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বলেছেন, ‘বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হলেও সংসদে যাবেন না। এলাকার কোনো উন্নয়ন হবে না। কাজেই বিএনপিকে ভোট দিলে সেই ভোট জলে যাবে। আর আমি নির্বাচিত হলে সংসদে যাব। এলাকার অনেক উন্নয়ন করব।’ আওয়ামী লীগের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো জনমত গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। নির্বাচিত হলে তিনি সংসদে যাবেন কি না, সে ব্যাপারেও কোনো কথা বলেননি বিএনপির প্রার্থী। তাই উন্নয়নের কথা ভেবেই এখানকার ভোটাররা বিএনপিকে ভোট দেননি।বিএনপির নেতারা এখানে হেরে যাওয়ার জন্য আরেকটি কারণ মনে করেন বিএনপির ভোটারদের ভোট দিতে না যাওয়া। এই আসনে ৯৫ হাজার ৬৫১ জন ভোটার ভোট দিতে যাননি। বিএনপি মনে করছে, এই ভোটারদের একটি বড় অংশই তাদের দলের ভোটার। উপনির্বাচনে ভোট দিয়ে কোনো লাভ হবে না, দলও ক্ষমতায় যাবে না—এমন ভাবনা থেকেই তাঁরা ভোট দেননি। তাই বিএনপি হেরেছে। তবে বিএনপি এখন চেষ্টা করছে এই পরাজয়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল করার। তারা এখন কারচুপির অভিযোগ তুলে এই নির্বাচন বাতিলের দাবি করছে।এই আসনের উপনির্বাচনে মোট ১২৬টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়। এর মধ্যে আটটি কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। নির্বাচন শেষে বিএনপির প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ওই আটটি কেন্দ্র বাদে সর্বত্র নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও একই কথা বলেছিলেন সংবাদমাধ্যমের কাছে।কিন্তু রাত সাড়ে ১০টায় যখন ১০০ কেন্দ্রের ফল ঘোষণা হয়ে যায় এবং বিএনপির প্রার্থী যখন ৩৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়েন, তখন জেলা বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনরায় এখানে নির্বাচন দাবি করে। এরপর তারা রোববার হরতালের কর্মসূচিও ঘোষণা করে। গতকাল শুক্রবার সারা দিন বিএনপির নেতারা হরতালের সমর্থনে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। পুরো শহরে উত্তেজনা বিরাজ করছে।ফলাফল ঘোষণার পর কেন অবস্থান বদলে গেল, জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দলীয়ভাবে যখন যে কেন্দ্রের কথা জেনেছি, সেটাই বলেছি। তাই পাঁচটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের কথা বলেছিলাম। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এর বাইরেও সব জায়গায় সমস্যা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী দিলে এই সমস্যা হতো না। নির্বাচন সুষ্ঠু হতো। বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করতেন।’এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী ও বেসরকারিভাবে নির্বাচিত র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ এবার শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন দেখেছে। নির্বাচনে হেরে বিএনপি এখন কারচুপির অভিযোগ করছে। শহরে হরতাল ডেকেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের কাছে এই হরতাল কৌতুক ছাড়া আর কিছু নয়।’বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন গতকাল বিকেলে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন আমাদের বলেছিল যে সেনা মোতায়েন করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা আগে সেনা মোতায়েন না করার ঘোষণা দেয়। এই সুযোগে ৩০টি কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়ে একতরফাভাবে সিল মেরেছে আওয়ামী লীগ। আমরা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি। সাধারণ মানুষের চাপে হরতাল ডেকেছি।’তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট শফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু ফল ঘোষণার পর বিএনপির অবস্থান কেন বদলে গেল, জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।