আছে বাজার, রিকশার গ্যারেজ, নির্মাণসামগ্রীও

Spread the love

এক কিলোমিটার ফুটপাতে ৮৪ বার ওঠানামা

শরিফুল হাসান

গ্রিন রোডের দুই পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটাচলা দায়। গ্রিনলাইফ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ফুটপাতজুড়ে ময়লা-আবর্জনা। হাসপাতালের বিপরীত দিকের ফুটপাতও রিকশার দখলে। আর নির্মাণকাজ চলা মাদার তেরেসা হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে রীতিমতো বাঁশের মাচা বানানো হয়েছে। তার নিচ দিয়ে চলাচল করছে মানুষ l ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
গ্রিন রোডের দুই পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটাচলা দায়। গ্রিনলাইফ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ফুটপাতজুড়ে ময়লা-আবর্জনা। হাসপাতালের বিপরীত দিকের ফুটপাতও রিকশার দখলে। আর নির্মাণকাজ চলা মাদার তেরেসা হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে রীতিমতো বাঁশের মাচা বানানো হয়েছে। তার নিচ দিয়ে চলাচল করছে মানুষ l ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের পদচারী-সেতু থেকে নেমে কেউ যদি গ্রিন রোডের পূর্ব পাশের ফুটপাত ধরে হেঁটে পান্থপথ মোড় পর্যন্ত যেতে চান, তবে তাঁকে এক কিলোমিটার পথ পেরোতে হবে। এটুকু পথ অতিক্রম করার সময় ৮৪ বার ফুটপাত থেকে সড়কে ওঠানামা করতে হবে। আবার কেউ যদি পান্থপথ থেকে পশ্চিম দিকের ফুটপাত ধরে ল্যাবএইড হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে চান, তাঁকে অন্তত ৬২ বার ওঠানামা করতে হবে।
কেবল ওঠানামা করলেই চলবে না, এই পথে যাওয়া-আসা করতে হলে পেরোতে হবে ফুটপাতের ওপর থাকা নানা ধরনের খুঁটি, বাহারি সব ভ্রাম্যমাণ দোকান। অনেক জায়গায় আবার ফুটপাতের ওপর আছে নির্মাণসামগ্রী। কোথাও ফুটপাত বলে কিছুই নেই।
রাজধানীর গ্রিন রোডের দুই পাশে আবাসিক এলাকা ছাড়াও আছে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল। রয়েছে শতাধিক ওষুধের দোকান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আছে কয়েকটি। ফলে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, অসুস্থ থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী—সবাইকে এই এলাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হয়। কিন্তু বাস্তবে নারী, শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধদের পক্ষে এই ফুটপাতে হাঁটা কঠিন।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পদচারী-সেতু থেকে নেমে গ্রিন রোডের দিকে ২০ কদম হাঁটতেই বিসিএসআইআর সেবা ও প্রদর্শনী কেন্দ্র। এর ঠিক সামনের ফুটপাতেই মাটির বিশাল স্তূপ। এতে করে ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তায় হাঁটতে হবে। কয়েক কদম হেঁটে দেখা গেল, ফুটপাত বলে কিছু নেই। সেখানে নির্মাণকাজ চলছে। বিসিএসআইআর গেটের সামনে এসে তৃতীয়বার ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামতে হবে। কারণ, এখানে ফুটপাতের জায়গা রাস্তায় মিশে গেছে। একটু এগিয়ে চতুর্থবারের মতো ফুটপাতে উঠতেই গোটা বিশেক দোকান পেরোতে হবে। শিঙাড়া, চা, পরোটার দোকান—কী নেই! ফুটপাতের ওপর বেঞ্চও বসানো হয়েছে। এসব পেরিয়ে সেন্ট্রাল রোডের দিকের ফুটপাতে আবার নামতে হবে। ফের ফুটপাতে উঠলে আবার চা-সিগারেটের দোকান। ল্যাবএইড হাসপাতাল, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল হাসপাতালের উল্টো দিকের ফুটপাতেরও একই অবস্থা। ফলমূল থেকে শুরু করে সবজি—বাহারি সব দোকান!
এগুলো পেরিয়ে সামনে এগোলে খাজা এনায়েতপুরী টাওয়ার, সেন্ট্রাল ফিজিওথেরাপি সেন্টার ও নর্থ রোডের প্রবেশপথের তিন জায়গায় ফুটপাত থেকে নামতে হবে। এরপরে র্যাং গ্স তাজ টাওয়ারের সামনে গেলে ভয়ংকর অবস্থা। সেখানে ফুটপাত বলে কিছুই নেই। ওয়াসা সেই জায়গায় পাইপ বসাচ্ছে। এই জায়গা পেরিয়ে সামনে এগোলে আবার শিঙাড়া-চা-সবজির নানা দোকান। এর উল্টো দিকের ফুটপাতেও একই অবস্থা। সেন্ট্রাল হাসপাতালের লাগোয়া ফুটপাতের ওপর মোটরসাইকেল রাখা, আছে নির্মাণসামগ্রীও।
গ্রিন হ্যামলেট, বিআরবি কেব্লসের গুদামঘর, ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, ভোজনবিলাস রেস্টুরেন্ট, রিলায়েন্স জেনারেল অ্যান্ড রেনাল হাসপাতাল, শেলনিবাস—প্রতিটি জায়গায় একাধিকবার ফুটপাত থেকে নামতে হবে। এখানে অনেক জায়গায় ফুটপাতে ইট-সিমেন্ট উঠে গেছে। গ্রিন লাইফ হাসপাতালের প্রবেশপথের ফুটপাতেও ওয়াসা কাটাকাটি করছে। আর এই হাসপাতাল থেকে বের হবার রাস্তার সামনের ফুটপাতটা এত উঁচু যে সেখান দিয়ে বৃদ্ধ কিংবা কোনো শিশুর হাঁটা অসম্ভব।
গ্রিন মার্ট, আলামিন রোডের সংযোগ সড়ক, গ্রিন ডেন্টাল, কাঁঠালবাগান বাজার, সুবাস্তু সপ্তবর্ণা টাওয়ার, ধানমন্ডি ক্লিনিক—প্রতিটি জায়গায় ফুটপাত থেকে ওঠানামা করতে হবে। নির্মাণকাজ চলা মাদার তেরেসা হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে রীতিমতো বাঁশ দিয়ে নির্মাণকাজ চলছে। বাঁশের মাচার নিচ দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।
কনসেপ্ট টাওয়ার, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল পেরিয়ে পান্থপথ পর্যন্ত আসতে গতকাল এই প্রতিবেদককে এভাবে মোট ৮৪ বার ওঠানামা করতে হয়েছে। রীতিমতো যুদ্ধ করে শিশুর হাতে হাত রেখে মা, বৃদ্ধ লোকজনকে দেখা গেল এ ফুটপাতে চলাফেরা করতে।
উল্টো দিকের কমফোর্ট হাসপাতাল, জিঞ্জিরা রেস্টুরেন্ট, বেজপা কমপ্লেক্স, সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ অসংখ্য জায়গা পেরিয়ে ল্যাবএইড পর্যন্ত যেতে ৬৪ বার ওঠানামা করতে হয় একজন পথচারীকে। এর মধ্যে গ্রিন রোড সরকারি কোয়ার্টারের সামনে ফুটপাত বলে কিছু নেই। সেখানে ড্রেন, বাকি অংশে রিকশার গ্যারেজ।
গ্রিন রোডের বাসিন্দা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মুশফিকুর রহিম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। এই ফুটপাত দিয়ে প্রতিদিন তাকে বাসায় ফিরতে হয়। মুশফিক বলল, এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে তার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে।
গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা বৃদ্ধ শাহরিয়ার করিম বলেন, ‘অন্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী বাদ দিলাম, এই দেশের ফুটপাতে তো বৃদ্ধ লোকেরও চলাচল করা সম্ভব নয়।
ঢাকার এই এলাকার ফুটপাতের দুরবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হোসেন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই এলাকার ফুটপাতগুলো মানুষের হাঁটাচলার মোটেও উপযুক্ত নয়। শাহবাগ, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত দখলমুক্ত করে মানুষের হাঁটার উপযোগী করা হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে এই এলাকাও হবে।’
ঢাকার ফুটপাত নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর অ্যা বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট। প্রতিষ্ঠানটির ‘বাসযোগ্য নগরী কর্মসূচি’র ব্যবস্থাপক মারুফ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার ৪৪ শতাংশ জায়গায় ফুটপাত নেই। আর যেখানে আছে সেখানেও হাঁটার পরিবেশ নেই। অথচ সারা পৃথিবীতে মানুষের হাঁটার কথা চিন্তা করে সব পরিকল্পনা করা হয়। আমরা জানি না, ঢাকায় কবে মানুষের হাঁটার যোগ্য ফুটপাত হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.