সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও শাস্তির বিধান নেই!
শরিফুল হাসান
সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে চালক কিংবা দায়ী ব্যক্তির কী ধরনের শাস্তি হবে, সে-সম্পর্কিত কোনো বিধান না রেখেই সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইনে সড়ক দুর্ঘটনা কী ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, তা-ও বলা হয়নি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলছে, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে বিষয়টি থাকায় আইনে আর আলাদা করে যুক্ত করা হয়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীরা খসড়া আইনটিকে ‘দুর্বল’ মনে করছেন।
তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এমন আইন করা যাবে, যাতে দোষী মালিক ও চালক উভয়েরই শাস্তি হবে। বতর্মানে যে খসড়াটি রয়েছে, তা চূড়ান্ত করার সময় প্রয়োজনীয় সব বিষয় যুক্ত করা হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ ছাড়া পারাপার করলে দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড হবে। নীরব এলাকা অতিক্রমের সময় হর্ন বাজালে বা উচ্চমাত্রার কোনো শব্দ করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। নিয়োগপত্র ছাড়া মোটরযানের চালক হলে বা রাখলে এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। আইনে চালকদের জন্য কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের কথাও বলা হয়েছে।
খসড়া সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৬ গত ২৪ জানুয়ারি ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। কাল ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আইন নিয়ে মতামত দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ঘটনায় শাস্তির বিষয়টি যেহেতু ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে আছে, তাই এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিষয়টি আইনে উল্লেখ করার কথা ভাবছি আমরা।’ তিনি বলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে কেউ মতামত দিতে পারবেন। এই মতামতের ভিত্তিতে আইনটি চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর আগে সড়ক পরিবহন ও চলাচল আইন, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫-এর খসড়ায় মোটরযান চালিয়ে অপর ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান ছিল। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং চালকের দোষসূচক পয়েন্ট কাটার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। আর কেউ আহত করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান ছিল। তবে নতুন আইনে এগুলো নেই। অভিযোগ উঠেছে, গাড়ির মালিক ও চালকদের চাপে এগুলো বাদ পড়েছে।
এর আগে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হবে ৩০৪(খ) ধারায়। এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৫ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ২১ হাজার ৮৫৫। ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। নিহত হয়েছিল ৮ হাজার ৫৮৯ জন। আর আহত হয়েছিল ১৭ হাজার ৫২৪ জন।
নিরাপদ সড়কের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই আইনটি আমাকে হতাশ করছে। এ আইনে শুধু যে দুর্ঘটনায় শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি, তা নয় বরং আরও অনেক কিছুই অস্পষ্ট। এসব অস্পষ্টতা দূর করতে হলে শুধু ওয়েবসাইটের মতামত নিলেই হবে না, বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের সবার মতামত নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে হবে। এরপর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আইন করতে হবে।
যে অপরাধে যে শাস্তি: ২০১১ সালে ‘সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। ২০১৩ সালে গঠিত কমিটি তা কমিয়ে ১৫ অধ্যায় ও ২৪২টি ধারায় চূড়ান্ত করে। ২০১৫ সালের খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। তবে সর্বশেষ খসড়ায় আইনটিকে ১৩টি অধ্যায় ও ৬৩ ধারায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
আইনের তফসিলে যে ৩১টি অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স জালিয়াতি নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বাদে অন্য কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত বা সংরক্ষণ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড হবে।
আগের মতো এই আইনেও আছে, লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানো নিষিদ্ধ। ১৮ বছর না হলে কেউ লাইসেন্স পাবেন না। তবে ভারী যানবাহন চালানোর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। আর পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬০ এবং অপেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি লাইসেন্স নিতে পারবেন না। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
গণপরিবহনে লাইসেন্স ছাড়া কন্ডাক্টর হলে বা নিয়োগ করলে তিন মাসের জেল বা তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। ট্রাফিক আইন বা সংকেত না মানলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। কোনো মোটরযান অতিরিক্ত ওজন বহন করলে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও গাড়ি পার্ক করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
খসড়ার ৪২ ধারায় মোটরযান চলাচলের জন্য ১০টি সাধারণ নির্দেশাবলি রয়েছে। কেউ মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালাতে পারবেন না। সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, সব অপরাধই জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য।
সড়ক পরিবহন আইনের ঘাটতি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করতে নাগরিক সংগঠনগুলো একটি জোট গড়েছে। এই জোটের আহ্বায়ক হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দফা বৈঠক করে আমরা এই আইনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি। খুব শিগগির আমরা আমাদের মতামত সরকারকে দেব।’
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৬-এর খসড়া প্রত্যাখ্যান করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধসহ পরিবেশবান্ধব গণমুখী আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, খসড়ায় দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি-সম্পর্কিত কোনো বিধান নেই। সড়ক দুর্ঘটনাকে অপরাধ ও দণ্ডবিধিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আবার সব ধরনের অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সব মহল থেকেই দাবি ছিল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা। আরও দুঃখের বিষয় হলো, আগের আইনে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বললে বা কানে ইয়ার ফোন রাখলে কী শাস্তি হবে, সেটি ছিল। নতুন আইনে সেগুলোও নেই।