অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই

Spread the love

শরিফুল হাসান

চিত্রা নদীর পারে- সিনেমাটার কথা মনে আছে আপনাদের? না হলে দেখে নিন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিল তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে।

পুর্ব পাকিস্তানের ছোট্ট জেলা নড়াইল ছিলো সিনেমার পটভূমি। সেই নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকগুলো বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ছবি দেখলাম সেগুলো চোখটাকে পোড়ায়, মনটাকেও। কিন্তু বিশ্বাস করেন কোন ছবিই নতুন নয়।

এই বাংলাদেশে কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কখনো রামু, কখনো কুমিল্লা, কোথাও তো কোথাও তো এভাবে জ্বলছেই। এই বাংলাশের পুরো মানচিত্রজুড়ে এমন পোড়া ছবির শেষ নেই। আওয়ামী লীগের গত ১২ বছরে সেগুলো তো বন্ধই হয়নি বরং নতুন এক উপদ্রব শুরু হয়েছে ধর্ম অবমাননান নামে হামলা! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এগুলোর কোনটারই বিচার হওয়া তো দূরের কথা উল্টো অনেক হিন্দুকেই জেলে যেতে হয়েছে।

আচ্ছা আপনাদের মনে আছে গতবছর কুমিল্লার এক পূজামণ্ডপে কোরান শরীফ রাখা নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল। কয়েকদিন পরে কিন্তু ঠিকই জানা গেল, মন্ডপে কোরআন শরিফ রাখা ব্যক্তির নাম ইকবাল হোসেন (৩৫)।

বাড়ি কুমিল্লা নগরের সুজানগর এলাকায়। অথচ এই ঘটনার জের ধরে জেলায় জেলায় হিন্দু বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুর আগুন দেয়া হলো। শত শত প্রতিমা ভাঙা হলো। শুধু এই দুটো ঘটনা নয়, এই দেশে গত ৫০ বছরে এমন একটা ঘটনার কথাও কেউ বলতে পারবে না যেখানে কোন একজন হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্ঠান সংখ্যাগরিষ্ঠের ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে কথা বলেছে।

আমি আমার ২০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে নাসিরনগর থেকে শুরু করে বরিশাল, রামু থেকে শুরু করে রংপুর এমন অনেক ঘটনা কাভার করেছি। সব জায়গায় দেখেছি একইরকম ঘটনা। কোন সত্য নেই, তদন্ত নেই, শুধু একটা গুজব বা মিথ্যাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। আচ্ছা আপনাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা মনে আছে?

২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর সকালে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরদিনই অনুসন্ধান করতে সেখানে গিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম আসল ঘটনা খুঁজে বের করতে।

শুনে অবাক হবেন রসরাজ নামের একজন জেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তিনি নাকি কাবা শরীফকে ব্যঙ্গ করে ফটোশপ বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। ঘটনার পরপরই হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রসরাজকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলে। আমি বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় জেলে গিয়ে রসরাজের সঙ্গে ঘন্টা খানেক কথা বলেছিলাম।

দেখেন এতোই মুর্খ মানুষ রসরাজ, ছবি এডিট তো পরের কথা নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নিজে খুলতে পারবে বলে মনে হয়নি। ঘটনা যখন ঘটে সে মাছ ধরতে বিলে ছিল। অথচ বলা হয়েছে তিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন। কিছু না করেও এই ঘটনায় তাকে দিনের পর দিন জেলে থাকতে হয়েছে। এ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রসরাজের ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ড–সংক্রান্ত ফরেনসিক প্রতিবেদন দিয়েছিল।

তাতে বলা হয়েছিল, রসরাজের ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ড থেকে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কোনো আলামত পায়নি পিবিআই। অথচ দেখেন দাঙ্গা কিন্তু হয়ে গেছে। এই দেশের প্রতিটা ঘটনা একইরকম। রামুর ঘটনা বলেন কিংবা যে কোন ঘটনা! আমি আজ পর্যন্ত কখনো শুনিনি কোন হিন্দু বা বৌদ্ধ কটাক্ষ করে এই বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে কোন পোস্ট দিয়েছেন।

অথচ দেখেন বারবারই এই ধরনের গুজব বা মিথ্যা থেকে হামলা হয়েছে। এই তো নড়াইলেই তো এক অধ্যক্ষকে মিথ্যা অভিযোগে লাঞ্ছিত করা হলো। এ কারণে আমি বহুদিন থেকে বলে আসছি ফেসবুকে কে কী লিখলো সেসবে না দেখে করো বাড়িতে হামলা করলে কোথাও আগুন দিলে আগে হামলাকারীদের বিচার করতে হবে। কারণ পৃথিবীর কোন আইনেই আরেকজনের বাড়িতে আগুনে দেওয়ার অধিকার নেই। কাজেই প্রতিটা ঘটনায় অনুসন্ধান না করে হামলাকারীদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া উচিত।

আফসোস সেই চর্চা না করে আমরা উল্টো পারলে হামলার শিকার মানুষগুলোকেই জেলে নেই আর বীরের মতো ঘুরে বেড়ায় হামলাকারীরা। আমরা মুখে মুখে যে যতোই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি না কেন বাস্তবতা হলো সারাবছর জুড়ে শুনবেন ওমকু জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুর, হামলা। শুক্রবার এলে তো রীতিমতো আতঙ্কে থাকতে হয় যে কোথায় কী ঘটলো! আসলে বুঝি একদল লোক বসেই থাকে হামলা করার জন্য। তাদের কোন তথ্য উপাত্ত লাগে না।

তারা জানে এই দেশে হিন্দুদের ওপর হামলা করলে কোন বিচার হবে না। এইসব কারণে মানুষ হিসেবে, এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে, একজন মুসলমান হিসেবে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। ভাবতে কষ্ট লাগে অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাদেশের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও নিয়মিতই হিন্দুদের বাড়িঘরে পূজামন্ডপে হামলা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র গতবছর বলেছিল, গত ৯ বছরে এই দেশে ৩৬৮৯ বার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে।

যারা সংখ্যাটি কত ভয়ানক অনুভব করতে পারছেন না তাদেরকে অন্যভাবে বলি, এই দেশে গড়ে প্রতিদিন একবার কিংবা তারও বেশি দেশের কোথাও না কোথাও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে! আসলে আমরা যখন রাষ্ট্রের ধর্ম ঠিক করে দেব, ইচ্ছেমতো হিন্দুদের নির্যাতন করবো, তাদের বাড়িঘর দখল করবো, তৃতীয় সারির নাগরিকের মর্যাদা দেবো, উঠতে বসতে মালাউন আর ভারতের দালাল বলে গালি দেবো, নারী হলে ধর্ষণ করবো, যাকে যখন প্রয়োজনে কান ধরে উঠবস করাবো, দেশছাড়া করতে বাধ্য করবো, তাহলে তো এমুনি হওয়ার কথা! একটু পেছনে তাকান। সেই চল্লিশের দশক থেকে এসব চলছেই!

১৯৪৭ সালে যারা ছিলো ৩৩ শতাংশ আজ সেটা কমে হয়েছে আট শতাংশ। একদিন শুনবেন নামতে নামতে প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। কেউ কেউ এখন হয়তো ভারতে মুসলমান নির্যাতনের কথা বলে বসবেন। ভাইরে সে‌খানেও কম বেশি মুসলমানদের উপর নির্যাতন হয়। কিন্তু কখনো কী শুনেছেন ওরা একজনও ভারত ছেড়ে চলে যেতে চায়! ভারতের কোন মুসলিম নাগরিক কখ‌নো কোন‌দিন ভারত ছেড়ে পাকিস্তান পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে চলে আসার কথা ভাবে না।

কারণ সে জানে ভারতে অন্তত ন্যায়বিচারটা সে পাবে! এই বাংলাদেশে? কোনদিন শুনেছেন প্রতিমা ভাঙ্গার ঘটনায় কারো সাজা হয়েছে? হিন্দুদের ঘরবাড়ি দখলের কারণে কারো সাজা হয়েছে? জানি এসবের কিছুই হবে না। কারণ আমরা সংখ্যাগুরু। আমরা গোটা জাতি আজ সংখ্যাগুরুর জাতি।

ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে গেছি যে সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারবো না। বোধহয় পারতেও চাই না। আর এই এখন দেশে সত্যিকারের কোনো অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নেই। বরং সবাই একটু একটু করে সাম্প্রদায়িক হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাই এখন এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় অবলম্বন। কেউ এর বাইরে নয়। আপনারা বলবেন, শুধু তো সমস্যার কথা বলছি সমাধান কী? সমাধান হলে শুধু আজকের নড়াইল কিংবা গতবছরের কুমিল্লা নয় এই দেশের প্রত্যেকটা হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

এমন একটা সংস্কৃতি গড়তে হবে যে কারো বাড়িতে হামলা হলে, আগুন দিলেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। হ্যা ধর্ম অবমাননা করে পোস্ট করলে মামলা হোক, বিচার হোক কিন্তু কারো বাড়িতে হামলার আগুন দেওয়ার অধিকার কারো নেই। এটা ফৌজদারি অপরাধ। যে মুসলমান ভাইয়েরা ইসলাম রক্ষান নামে উত্তেজনা দেখিয়ে এসব করেন তাদের বলবো, দেখেন ইসলাম আর রাসুলকে (সা.) রক্ষার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলে গেছেন, ধর্ম নিয়ে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে বহু জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পারলে এই কথাগুলোর মর্ম বুঝুন। এই যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে আজকে সৌদি আরব তার আকাশসীমা ব্যবহার করে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দিলো পারলে সেগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করুন। পারলে দুর্নীতি অনিয়ম জমি দখল এতিমের সম্পদ দখল, হারাম হালাল এসব নিয়ে প্রতিবাদ করুন। যাকাত দিন। দয়া করে আরেকজনের বাড়িতে হামলা চালাবেন না। জানি কথাগুলো বৃথা যাবে। তাও রাষ্ট্র ও সরকারকে বলবো, ঘটনাগুলোকে সিরিয়াসলি নেন। দেশের স্বার্থেই আমাদের এই ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে।

মুসলমান হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিষ্ঠান হোক, আদিবাসী হোক এই দেশে সবার অধিকার একইরকম হতে হবে। কারণ দেশটা স্বাধীন করতে সবাই একসাথে লড়াই করেছে। কাজেই একসঙ্গে মিলে বাঁচতে হবে। একসঙ্গে মিলে লড়তে হবে। আমাদের সবেইকে মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে হারলে আমাদের পরিনতি হবে ভয়াবহ!

তখন দেখবেন মারামারি হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। যেমন হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা অন্য কোন দেশে। কাজেই চলুন সোচ্চার হই। লড়াই করি সম্মিলিতভাবে। আল্লাহ আমাদের বোধ দিক। সবাই ভালো থাকুন। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published.